এই নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো এই ঘটনা ঘটল। আমি আজও পারলাম না। হাসানের কারণেই। কেন যে আমাকে ও বারবার পিছু ডাকে। ওকে তো আমি কিছু দিই না। অপারেশনের পর প্রজনন অক্ষমতার সাথে সাথে আমার শরীরের অন্যতম স্পর্শকাতর অংশের অনুভূতির নির্জীবতা কি একটুও উৎকণ্ঠিত করে না হাসানকে? নাকি ওর ভালমানুষিটা এমনিই। লোক দেখানো?
কই ওর চোখের সরলতা তো ঠিক আগের মতোই আছে। তবে কেন ওর শারীরিক নির্লিপ্ততা আমার মনে অদ্ভুত সব প্রশ্নের জন্ম দেয়। আমার অপারেশন পরবর্তী জটিলতা এখনও কাটেনি। বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে। আশেপাশের মানুষ জানে, সুরভির বাইশ সপ্তাহের বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে গেল। আর আমি জানি আমার কত কী নষ্ট হয়ে গেল। অপারেশন টেবিলে শুয়ে শুনেছি, নার্সরা কানের কাছে গুনগুন করেছে, এই বয়সে হিস্টারেকটমি! শব্দটা আমার কানে খুট করে লেগেছিল। কারণ এই শব্দটা আমার চেনা শব্দ ছিল।
সুরভি তাকাও, তাকাও আমার দিকে। তাকাও বলছি।
হাসানের ধমক শুনেও আমার কোনো ভ্রুক্ষেপ হয় না। আমার মাথা শূন্য শূন্য লাগছে। বিছানায় শুয়ে পড়তে মন চাইছে। হাসান আমাকে এত শক্ত করে ধরে রেখেছে যে আমি কিছুতেই নিজেকে ছাড়াতে পারছি না। ও আমার মাথায় পানি ঢালতে গিয়ে আমার গলা-বুক পেটসহ প্রায় সমস্ত শরীর ভিজিয়ে ফেলেছে। অবশ্য ভেজা কাপড়ে আমার আরাম লাগছে। চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। আমি হাসানের ডান হাত খামচে ধরি। ও চাপা গলায় বলে,
গলায় আঙুল ঢুকাও। ঢুকাও বলছি। এক্ষুনি বমি করো।
পারবো না।
তাহলে এখনই ধরে হাসপাতালে নিয়ে যাবো, গলায় নল ঢুকিয়ে ওরা ওষুধ বের করবে। তুমি কী চাও আস্থা ঘুম ভেঙে এসব দেখুক। বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।
আরে কিছু হবে না আমার। বেশি ওষুধ খাইনি। চারটা কী পাঁচটা খেয়েছি।
যে কয়টাই খাও। এখনই বমি করো। চলো, বাথরুমে চলো।
আমি হাসি। ক্ষ্যাপাটে হাসি।
ভয় পেয়েছো?
আমার কথার জবাব না দিয়ে হাসান আমাকে হিড়হিড় করে টেনে বাথরুমে নিয়ে যায়। বেসিনের ওপর আমার মাথা চেপে ধরে ও অসহিষ্ণু গলায় বলতে থাকে,
বমি তোমাকে করতেই হবে। বমি করতেই হবে সুরভি।
বেসিন থেকে উৎকট একটা গন্ধ নাকে লাগতেই আমি বমি করে ফেলি। সাদা বেসিনের ওপর হলদেটে থকথকে বমি দেখে আমার বমির বেগ বেড়ে যায়। হাসান আলতো করে আমার পিঠে হাত বুলায়।
এসব পাগলামির অর্থ কী সুরভি? তুমি কি আমাদের কথাও একটু ভাববে না? এত স্বার্থপর তুমি?
হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি স্বার্থপর! আমি খুব স্বার্থপর। স্বার্থপর না হলে কী আমি আমার বাচ্চাকে মেরে ফেলি?
কেন এসব বলছো? কেন? চুপ করো সুরভি। চুপ করো।
হাসানের কণ্ঠস্বরে মিনতি ঝরে পড়ে। বহুদিনপর ও আমাকে নিবিড়ভাবে আলিঙ্গন করে।
এখন ছাড়ো আমাকে। আমি ঠিক আছি।
হুম, এখন হাতমুখ ধুয়ে বিছানায় চলে এসো।
শোবার ঘরের আলো জ্বলছে। বিছানায় একটা মেয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। আমি মেয়েটিকে চিনতে পারছি না। আমি অনেকক্ষণ ধরে ঘুমন্ত বাচ্চাটির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। বাচ্চা মেয়েটা ঘুমের ভেতর হাসছে। হাসতে হাসতে মেয়েটা জিহ্বা দিয়ে নিচের ঠোঁট চেটে নেয়, যেন খুব মজার কিছু খাচ্ছে। আচমকা আমার মনে পড়ে এ আমার মেয়ে। কিন্তু নাম কী ওর? আশ্চর্য এ আমি কী করে ভুলে গেলাম? আহ্! কদিন ধরে মাথার ভেতরে কীসব যন্ত্রণা যে শুরু হয়েছে!
আমার চুলের ভেতর কী যেন কুটকুট করছে। চুলে উকুন হয়েছে। অস্থির হয়ে আমি নখ দিয়ে মাথায় খামচাতে থাকি। নখের অগ্রভাগে একটা পেটমোটা উকুন চলে এসেছে। আমার মাথা এবার হালকা লাগছে এবং অবাক ব্যাপার হচ্ছে আমার মনে পড়েছে, আমার মেয়ের নাম আস্থা আর আস্থার চেহারা ঠিক ওর বাবা হাসানের মতো।
আমি আলো নিভিয়ে দিচ্ছি। বিছানায় এসো। তার আগে জামা পাল্টে নাও।
বলতে বলতে হাসান আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ে। যেন ও জানে এখন আর কোনো দুর্ঘটনা ঘটবার আশংকা নেই। আমি ভেজা কাপড়েই বারান্দায় এসে দাঁড়াই। অদ্ভুত একটা অবসন্নতা ঘিরে ধরেছে আমাকে। অনেক বেশি পাগলামি করে ফেলেছি আজ। হাসান কখন যে পিছনে দাঁড়িয়েছিল আমি টের পাইনি। ও ঠিক টের পেয়েছে আমি কিছু একটা করতে যাচ্ছি। কিন্তু কী আর করবো আমি? আর কত সহ্য করবো?
রোজ রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে আমি যখন চোখ বন্ধ করি তখন দুই চোখের গহ্বরের ভৌতিক অন্ধকার ফুঁড়ে একটা কচিকণ্ঠের ডাক আমার সমস্ত চৈতন্যকে এফোঁড়ওফোঁড় করে দেয়। ক্রমাগত আমাকে ডাকতে থাকে,‘ মা তুমি কই, মা তুমি কই? এই যে, এই যে আমি।’
এ এক দুর্মর যন্ত্রণা। এ যন্ত্রণা শুরু হলে আজকাল আমার ভাবনাগুলো জট পাকিয়ে যায়। তখন নিজের ওপর আমার নিয়ন্ত্রণ থাকে না। চব্বিশঘন্টার মধ্যে বেশ কয়েকবার বিষয়টা ঘটে। বিশেষ করে রাতের বেলা। কাউকে রাতের এই অস্থিরতা বোঝানোর মতো ক্ষমতা আমার নেই। রাত গভীর হলে উদ্ভট সব ভাবনা আমাকে জাপটে ধরে।
সত্যি বলছি, রাত যত গভীর হয় প্রাপ্তির ভেলভেটে মোড়া এই জীবন বড় নগন্য লাগে। দিনের ক্যানভাসে আঁকা সুখের সকল মেকি কারুকাজ ম্লান হয়ে এলে রাত্রির গলা জড়িয়ে ক্লান্তি নামে, সকল ছলনা ভুলে মন ধসে বেরিয়ে আসে অগুনতি দীর্ঘশ্বাস। হাঁ করে গিলতে এসে কুহক অন্ধরাত বধির কানে ঠোঁট চেপে কত কী আউড়ে চলে।
অথচ আমি কাউকে বলতে পারি না, যে আমি অন্যকে ভালবাসতে ভুলে গেছি, সে আমি এখন নিজেকেও ভালবাসি না। আমি কাউকে এ কথা হাসানকেও বলতে পারি না। শুধু ডাক্তারকে বলেছি, আজকাল সামান্য কিছুতেই আমার খুব রাগ হয়। রাগের ঝটকায় আমার মাথার দুপাশের শিরা দপদপ করে। হাসান তখন ডাক্তারকে আমার আত্মহত্যা করার প্রবণতার কথা বলতেই অন্য সবার মতো মুখে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে ডাক্তার বলেছিলেন, সবে একটা অ্যাবরশন হলো। সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আমি জানি, কিছুই ঠিক হবে না। বুকের নিভৃতে আমি যে সাত জনমের হাহাকার গেঁথে নিয়েছি তা কখনো ঠিক হবার নয়।
আমি আকাশের দিকে তাকাই। পূর্ণিমার আকাশ আমার খুব প্রিয়। আকাশের কালো রঙে এখন সাদা অন্ধকারের বাড়াবাড়ি। ঝলমলে তারার ঝালর পরম আদরে আকাশকে জড়িয়ে রেখেছে। চারপাশে স্থির শূন্যতা। গোটা শহর কি ঘুমিয়ে গেছে? হঠাৎ এই নিস্তব্ধতা ভেদ করে খুব কাছাকাছি কারো কান্নার শব্দ শোনা যায়। কে কাঁদছে? কে? খুনখুন করে কাঁদছে। নারীকণ্ঠের কান্না। ধীরে ধীরে কান্নার বেগ বাড়ছে।
এত রাতে কী শহরে ভুত-প্রেত নেমে এলো? ছেলেবেলায় দাদীর মুখে গল্প শুনেছি, রাজা শিকারে বের হলে তাকে ভুলাতে ডাইনি গাছের নিচে বসে কাঁদতো। তখন তো সেই গল্প শুনে ভয় পাবার বদলে খিলখিল করে হাসতাম, দাদীকে বড্ড বোকা মনে হতো।
অথচ কত চেনা-অচেনা ভয়ে আমার শরীর এখন শিউরে উঠছে। এ তো মানুষের কান্না! না, একজনের কান্নাও তো নয়! সম্বস্বরে অনেকেই কাঁদছে। উউউ...। অবিশ্রান্ত, বিরামহীন। এ মায়েদের কান্না? হ্যাঁ, তাই তো! কী তীক্ষ্ম আর তীব্র বিষাদময় এই সুর! আমি টের পাই সুরেলা সেই কান্না আকাশের বুকে প্রতিধ্বনিত হয়ে আবার মাটিতে ফিরে আসছে। শুনে মনে হচ্ছে কান্নার এই সুর সাত আসমান ভেদ করতে না পারার ব্যর্থতায় ছটফটাচ্ছে। অবাক চোখে তাকিয়ে দেখি, তারার চাদরে লেগে সেই কান্না আমার শরীরে ছিটকে পড়ছে আর আমাকে ঘিরে থাকা বাতাস প্রগাঢ় মমতায় এদের আলিঙ্গন করে নিচ্ছে।
আহা! কত শত দেবশিশুর প্রস্থানের বেদনাক্রান্ত দুঃখিনী মায়েদের এই হাহাকারের পৌনঃপুনিকতায় বাতাস আজ জলীয় হয়ে উঠছে। এবার আমিও সেই মায়েদের দলে যোগ দিই। কান্নার প্রাবল্যে আমার বুক ভেঙে যায়। আমার হৃদস্পন্দন ধাক্কা খায় জলের সরলতায়। আমার পরনের ভেজা জামা আরও ভিজতে থাকে। মিষ্টি একটা বাতাসের হলকা এসে আমাকে কাঁপিয়ে দেয়।
আমি কান পাতি, আকাশের দিকে আমার দৃষ্টি প্রসারিত করি। ও কি এখনই আসবে? আকাশের দরোজা খুলে বের হবে? তারার আড়ালে ভাসতে ভাসতে আমাকে খুঁজবে? বলবে, 'ও মা, মাগো, তুমি কই?'
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
একজন মায়ের অজাত সন্তানের জন্য কষ্টের গল্প। যেই অবিভাজ্য কষ্টেরা মাঝরাতে মাকে তাড়িয়ে বেড়ায় দস্যুর মতো। মায়ের কান্না সুদূর আসমানের গায়ে প্রতিধ্বনিত
১৯ অক্টোবর - ২০১৩
গল্প/কবিতা:
২১ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪